এশিয়ার প্রাচীনতম বাংলা সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশ ১৯৩০

প্রিন্ট রেজি নং- চ ৩২

৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

অন্তবর্তী সরকারের এক মাসে অর্জনের চেয়ে চ্যালেঞ্জ বেশি

Daily Jugabheri
প্রকাশিত ০৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০২৪ ১৫:২৪:০২
অন্তবর্তী সরকারের এক মাসে অর্জনের চেয়ে চ্যালেঞ্জ বেশি

যুগভেরী ডেস্ক ::: অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হচ্ছে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর)। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালানোর মধ্যে দিয়ে সরকার গঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে করা হয় অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসাবে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, উন্নয়ন সহযোগী এবং দাতা সংস্থাগুলো অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ইউনূস সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে।

বিগত সরকারের অন্যতম সমস্যা ছিল মানুষের আস্থার অভাব। বিশেষ করে পরিসংখ্যানগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়াও নির্বাচন, গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি, গুম, খুন এবং রাষ্ট্রীয় মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব তথ্য প্রচার করা হতো, তার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন না। এ অবস্থায় মানুষের মাঝে আস্থা ফেরানো সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মনে করছেন।

 

অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে ছিলো। তলানিতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বাড়তে শুরু করেছে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছে। রাজনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। এর আগে একটি দল ও জোট ছাড়া অন্যদের রাজনৈতিক কর্মসূচি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সরকারবিরোধী বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন ছিল। এখন মানুষ কথা বলতে পারছে।

গণআন্দোলনের সময় গণহত্যা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ। এ গণহত্যার বিচারের বিষয়টি সামনে আসছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের কথা বলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অপরাধ তদন্তে প্রসিকিউশন গঠন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় শেখ হাসিনাকে আসামি করে ১৮০টির মতো মামলা হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হতে পারে।

সরকার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক ছিল। তখন টানা এক সপ্তাহ কর্মবিরতি পালন করেছে পুলিশ। ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তবে আইনশুঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতি করা প্রয়োজন।

সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ অন্তত ১২ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে ৫২ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। এই বন্যা মোকাবিলায় সারা দেশের মানুষ, ছাত্র-জনতা এবং সরকারের উদ্যোগ ছিল নজিরবিহীন। বন্যা-পরবর্তী এসব জেলায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়াকেও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে।

আন্দোলন চলাকালীন এবং পরে সবচেয়ে বেশি অচল ছিল শিক্ষা খাত। আলোচ্য সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছুই বন্ধ ছিল। তবে শিক্ষা খাতে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল তা কাটাতে কাজ শুরু করেছে।

এই ‘বিশেষ সরকার’ ঠিক কতদিন সময় নিয়ে তাদের সংস্কার কার্যক্রম চালাবে, বিগত এক মাসে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে এ বিষয়ে কিছু ধারণা মিলেছে। অন্তর্র্বতী সরকার কতোদিন থাকবে, এ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। যদিও তাদের ওপর রয়েছে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং বৈষম্য নিরসনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ চাপ। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকরা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ‘অন্তত দুই থেকে তিন বছর’ দায়িত্ব পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কোনো সময় উল্লেখ না করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছিলেন। কিন্তু এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যে বৈঠক হয় সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়া হবে। এই যৌক্তিক সময়টা ঠিক কতদিনের তা স্পষ্ট করা হয়নি।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথাই বলেছে। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগই ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। গত ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়কালে তারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সময়সীমা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো পৃথকভাবে সংস্কার প্রস্তাবও সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কারের জন্য যতদিন লাগে ততদিনই যেন এই সরকার থাকে।

গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া প্রথম ভাষণে সরকারের সময়সীমার প্রসঙ্গটি ছিল। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। ৃ কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব, যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয় আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে, আমরা চলে যাব।’

তবে মেয়াদ নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী লিয়াজোঁ কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেশি সময় নিলে অন্তর্র্বতী সরকারের জনপ্রিয়তা কমবে, নানাবিধ চাপ তৈরি হবে। তাই যৌক্তিক সময় মানে যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজ শেষ করা উচিত। এর মধ্যেই সংস্কার শেষ হতে হবে।
এদিকে এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত তা জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অপরিহার্য রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভীষ্ট অর্জনের যে গুরুদায়িত্ব অন্তর্র্বতী সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছে তা সম্পন্ন করতে যত সময় লাগবে, ততটাই তাদের হাতে থাকা উচিত। কোনো সুনির্দিষ্ট টাইমলাইনের প্রশ্ন এ পর্যায়ে যৌক্তিক মনে করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার তাদের এ বিশাল দায়িত্বের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বিবেচনায় যথাসময়ে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন বলে আশা করা যায়, যার ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করা সম্ভব হতে পারে। এ বিষয়ে তড়িঘড়ি করা ইতিবাচক হবে না। মনে রাখতে হবে, একটি দলীয়করণ-ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি অপর একটি দলীয়করণ-নির্ভর ও বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার উত্থানের ঝুঁকি রয়ে যায়, তবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অভীষ্ট অধরাই থেকে যাবে।’

অন্তর্র্বতী সরকারের দায়িত্ব সম্পন্ন করতে কতদিন সময় লাগতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেনে, ‘কী করতে চান, কতদূর করতে চান তার ওপরই আসলে সময় নির্ভর করছে। তারা যেটুকু বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কার করতে চান, দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে চান, অর্থনৈতিক সংস্কার করতে চান, এসব করতে গেলে তো আমার মনে হয় কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কার সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সংবিধান পরিবর্তনের যে কথা বলা হচ্ছে সেটাও সময়সাপেক্ষ।’

এর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বতী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিল। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোও নির্ধারিত তিন মাস সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করেছে। তবে ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম বিদেশ সফরে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যাবেন তিনি। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি।

সংবাদটি ভালো লাগলে স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন