এশিয়ার প্রাচীনতম বাংলা সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশ ১৯৩০

প্রিন্ট রেজি নং- চ ৩২

১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

জটিল রোগীকে প্রেসক্রিপশন ‘দ্রুত সিলেটে যান’

Daily Jugabheri
প্রকাশিত ২০ মে, সোমবার, ২০২৪ ০৩:০৯:২৫
জটিল রোগীকে প্রেসক্রিপশন ‘দ্রুত সিলেটে যান’

নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ ::
সুনামগঞ্জের ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি নিজেই যেন রোগী হয়ে আছে। জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রটিতে জটিল-কঠিন রোগের কোনো চিকিৎসাই হয় না। সামান্য কাটাছেঁড়া কিংবা ব্যথায়ও রোগীদের একটাই প্রেসক্রিপশন দিতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা- দ্রুত সিলেট যান। সর্দি-কাশির মতো গতানুগতিক রোগের সেবা পেতেও এখানে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা।
হাসপাতালটিতে রেডিওলজিস্টের পদ শূন্য থাকায় রোগ নির্ণয়ে এক্স-রে মেশিনের ব্যবহার বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে। গত সোমবার বন্ধ হয়ে গেছে আলট্রাসনোগ্রাফিও। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা, ডাক্তার-কর্মচারীসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনবল সংকট- সব মিলিয়ে জেলা সদরের হাসপাতালটির সেবার মান দাঁড়িয়েছে গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিকের পর্যায়ে। যেখানে ছোটখাটো সমস্যা ছাড়া বড় রোগের কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী দেখা মাত্রই পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেটে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সীমিত জনবল দিয়ে সেবা দিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন তারা। তবে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে। তবে এমন চেষ্টার কথা বহুদিন ধরে বলা হলেও দৃশ্যত তার কোনো ছাপ নেই কোথাও।
২০০৯ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়া এ হাসপাতালে জনবল সংকট লেগেই আছে। বিশেষ করে এটি চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্টের শূন্যতায় ভুগছে বছরের পর বছর। যেখানে এখন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি চিকিৎসকের পদ শূন্য। দায়িত্বশীলরা জানান, চিকিৎসকের ৬৬ পদের বিপরীতে কর্মরত ৩০ জন। পদ শূন্য রয়েছে ৩৬টি। এর মধ্যে ২৩টি কনসালট্যান্ট পদের ১৩টিতেই জনবল সংকট রয়েছে।
এ ছাড়া জরুরি শূন্যপদের মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি ও চক্ষু), জুনিয়র কনসালট্যান্টের (সার্জারি ও চক্ষু) মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এ ছাড়া ইএনটি, অ্যানেস্থেশিয়া, গাইনি, কার্ডিওলজি ও ডেন্টাল সেক্টরে নেই সিনিয়র কনসালট্যান্ট। প্যাথলজি ও রেডিওলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্টের পদও ফাঁকা।
হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক হযরত আলী রোববার শেষ অফিস করেছেন। তাঁকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করা হয়েছে। যার কারণে সোমবার থেকে হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম বিভাগও অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় রোগীদের রোগ নির্ণয় ও সেবা প্রদানে সমস্যা প্রকট হয়েছে।
হাসপাতালের একজন সিনিয়র চিকিৎসক জানান, এ হাসপাতালে এখন সার্জারি করা হয় না বললেই চলে। সার্জিক্যাল সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত জরুরি প্রতিটি বিভাগেই লোক সংকট। সাধারণ বুকে ব্যথা নিয়ে কেউ হাসপাতালে এলে তারও পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপায় নেই। ঝুঁকি না নিয়ে তাই চিকিৎসক অন্যত্র রেফার করে দেন। হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, মূল ভবনের প্রধান ফটকের সামনে রোগীর ভিড়। অনেকে জানতে চাচ্ছেন আটতলা ভবনের কোথায় গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন। তবে রোগীদের এই নির্দেশনাটুকু দেওয়ার মতোও কাউকে দেখা যায়নি সেখানে। এখানে সর্দি-কাশি, জ্বর, পেটের পীড়া ছাড়া জটিল রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নানামুখী সংকটের কারণে চিকিৎসকরাও কোনো ঝুঁকি না নিয়ে রোগীদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন অন্য কোথাও, বিশেষ করে সিলেটে।
রফিকুল ইসলাম নামের গৌরারংয়ের এক বাসিন্দা এগিয়ে এসে জানান, এখানে বেশির ভাগ সময়ই দালাল থাকে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেলেই সরে যায়। এই দালালরা সুযোগ পেলেই বাইরের ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে দেয়। এখানে চিকিৎসক না থাকা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংকটের কথা বলে রোগী বাগাতে তাদের আরও সুবিধা হয়। আটতলার এই হাসপাতাল ভবনে কোনো ফ্রন্ট ডেস্ক বা তথ্যকেন্দ্রও নেই।
হাসপাতালের ওয়ার্ডের রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার ও ইনডোর মেডিকেল অফিসার (আইএমও) থাকা জরুরি। এখানে সেই পদগুলোও শূন্য। এ কারণে ওয়ার্ডের রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না। হাসপাতালটিতে মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জনের ৩২টি পদের মধ্যে ১৭টি ফাঁকা। নার্সের ২৫৪টি পদের মধ্যে ১৯৭ জন থাকলেও অনেকের সেবাদানে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ হাসপাতালটির একাধিক চিকিৎসক। রোগীদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে নানা অভিযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, অনেক নার্স ডাক্তার বা প্রশাসনের আদেশ ঠিকভাবে পালন করেন না। নিজেদের ইচ্ছামতো ডিউটি করেন। রোগীদের সেবা প্রদানে তাদের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অথচ নার্সদের সেবা একজন রোগীর সুস্থতার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
ওই চিকিৎসক জানান, ডাক্তাররা ওষুধ লিখে দিলে সেগুলো রোগীদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। হাসপাতালে কোনটা আছে কোনটা নেই, সেটা দেখে স্লিপ দেওয়ার কাজটাও অনেকে ঠিকমতো করেন না। এতে অনেক রোগী মনে করেন, হাসপাতালে এসে ওষুধ পাওয়া যায় না।
হাসপাতালের অন্যান্য ক্ষেত্রেও লোকবল সংকটের কারণে সেবা বিঘিœত হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী ২৪ জনের জায়গায় কাজ করছেন ১৩ জন। এর মধ্যে অনেকেই অনিয়মিত। চতুর্থ শ্রেণির ৬৫ জন স্টাফ আছে, যাদের আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালীদের তদবিরে তাদের চাকরি হয়েছে। যার কারণে দায়িত্ব পালনে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে এগুলো বলতে গেলে উল্টো সমস্যায় পড়তে হয় চিকিৎসকদের। এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক চিকিৎসক। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থানীয় সমস্যা এড়াতে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তাদের কেউ।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট বিষ্ণুপ্রসাদ চন্দ জানান, চোখের সমস্যা নিয়ে কেউ এলে চিকিৎসা দিতে পারেন না তারা। রিকশা থেকে পড়ে কেউ আঘাত পেলে কিংবা খানিক কাটাছেঁড়ার ক্ষেত্রেও রোগী পাঠিয়ে দিতে হয় সিলেটে। এখানে কর্মরত চিকিৎসকরা নিরুপায়। ইচ্ছে থাকলেও সেবা দিতে পারছেন
না তারা। কার্ডিওলজিস্ট ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) নেই। সামান্য বুকের ব্যথা নিয়ে কেউ এলে তাদের একটাই কথা বলতে হয়- দ্রুত সিলেট যান।
অর্থোপেডিকসের সিনিয়র কনসালট্যান্ট বিপুল ঘোষ জানান, রেডিওলজিস্টসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় কাজের পরিবেশ পাচ্ছেন না জেলা সদরের এ হাসপাতালে। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, সব সমস্যার কথা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৪০০ রোগীকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়। সেটি বিবেচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাদিক জানান, হাসপাতালের সমস্যা সম্পর্কে জেনেই সব তথ্যাদি সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালটিকে সেবা প্রদানে সর্বোচ্চ সক্ষমতা দেওয়া হবে। সদর হাসপাতালের পুঞ্জীভূত সমস্যা দীর্ঘদিনের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এসব বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে কথা বলেছেন।

সংবাদটি ভালো লাগলে স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন