এশিয়ার প্রাচীনতম বাংলা সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশ ১৯৩০

প্রিন্ট রেজি নং- চ ৩২

২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

কোটা আন্দোলন : এ পর্যন্ত সিলেটে যতজন গ্রেফতার

Daily Jugabheri
প্রকাশিত ০১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ২০২৪ ১৮:২৪:৩০
কোটা আন্দোলন : এ পর্যন্ত সিলেটে যতজন গ্রেফতার

যুগভেরী ডেস্ক ::: কোটা ইস্যুর আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সহিংসতায় সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার ৩ থানায় মোট ১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) পর্যন্ত ১৫৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) মিডিয়া অফিসার অতিরক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বৃহস্পতিবারর দুপুরে জানান- বুধবার রাত পর্যন্ত সিলেটে ১১ মামলায় ১৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে এসএমপি’র উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন- বৃহস্পতিবার বিকালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ফটক থেকে দুজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

 

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলন এক পর্যায়ে সিলেটে সহিংস হয়ে উঠে। আন্দোলনটি প্রথমে অহিংস থাকলেও ১৪ জুলাই রাত থেকে হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠে সিলেট। ১৬ জুলাই সারা দেশে ৬ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। দেশের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠলে ওই দিন রাতে দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ সব কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এছাড়া ১৭ জুলাই বিকাল ৩টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় শাবি প্রশাসন। কিন্তু এসব নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে শাবি’র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলে থেকে যায় এবং সেদিন দিনভর নানা কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া এদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলের কয়েকটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো দা ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে তারা। এসব জিনিস ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি তাদের। পরে সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিং করে এগুলো শাবি প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে তারা।

সিলেটে ১৭, ১৮ ও ১৯ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ১৮ জুলাই সকাল থেকে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক দেয়। জরুরি সেবার যানবাহন ও অফিস ছাড়া সব বন্ধ রাখতে আহ্বান জানায় তারা। এ কর্মসূচি পালনে ওই দিন বেলা ১১টা ২০ মিনিটে শাবি ফটকের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো শাবি ছাত্র-ছাত্রী। তাদের ঘিরে সতর্ক অবস্থানে থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী। ১৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে শাবি ক্যাম্পাসের দখল নেয় পুলিশ। মোতায়েন করা হয় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) বিশেষ বাহিনী ‘ক্রাইসিস রেন্সপন্স টিম (সিআরটি)’। এসময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা ও মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশ এবং শিক্ষার্থীদের দ্রুত হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশের নির্দেশে দুপুর পর্যন্ত প্রায় সকলেই হল ছেড়ে চলে যান।

 

দুপুর সোয়া ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের দখল নিতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এসময় দুপক্ষের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ও ককটেল ছুঁড়ে মারতে শুরু করে। এর জবাবে পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড নিক্ষেপ করা হয়।

 

আধা ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে ৫ পুলিশ সদস্যসহ প্রায় অর্ধশত জন আহত হন। এর মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এসময় একজনকে আটক করা হয়। তবে আটক যুবক শিক্ষার্থী নয় বলে জানা গেছে।

 

এ সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও এর কিছুক্ষণ পর শাবি’র পার্শ্ববর্তী আখালিয়া এলাকার মাউন্ট এডোরা হসপিটালের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে আন্দোলনকারীরা জড়ো হয়ে ফের অবরোধ করে। এসময় পুলিশ এসে তাদের সড়ক থেকে তুলে চাইলে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে এ সংঘর্ষে এসে জড়িত হন সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখা যায়।

 

শিক্ষার্থীদের দাবি- ছাত্রলীগের কাছে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্রও ছিলো। তারা মুহুর্মূহু গুলি ছুঁড়ে শিক্ষার্থীদের দিকে। ৪ ঘণ্টাব্যাপী চলা এ সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিক, ছাত্রলীগ, পথচারী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ শতাধিক জন আহত হয়েছেন। বিকাল ৫টার দিকে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে পুলিশ। এছাড়া বিজিব ও র‌্যাবের একাধিক টিম শাবি এলাকায় টহল শুরু করে। সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

 

তবে রাত ১০টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয় বলে জানা গেছে।

 

ওই দিন সন্ধ্যার পর শাবি’র পার্শ্ববর্তী সুরমা গেইট এলাকায় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারী চার শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে যান। এসময় ৩ জন সাঁতার কেটে ওঠতে সক্ষম হলেও রুদ্র সেন (২২) নামে এক শিক্ষার্থী মারা যান। নিহত রুদ্র সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলায়। শিক্ষার্থীদের অনেকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। পৃথক ঘটনায় পুলিশ ছয়জনকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।

 

পরদিন ১৯ জুলাই সিলেটে আরও বেগবান হয় আন্দোলন। ওইদিন জুমার নামাজের পর কোটা আন্দোলন ইস্যুতে মহানগরের কোর্ট পয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপির অংগসংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি জিন্দাবাজার অভিমুখে রওয়ানা হয়। মিছিলকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেয় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ওই সময় কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান করছিল পুলিশ। তখন এসএমপির সহকারী কমিশনার গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে মিছিলে টিয়ারশেল ও গুলি ছুঁড়ে। এসময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন দৈনিক জালালাবাদ ও নয়াদিগন্ত পত্রিকার রিপোর্টার এটিএম তুরাব।

 

গুরুতর অবস্থায় সহকর্মীরা তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু শুক্রবার থাকায় চিকিৎসকের পরিবর্তে নার্সরা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখতে পেয়ে সহকর্মীরা তাকে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফ মোহাম্মদ রেজা।

 

পরদিন শনিবার (২০ জুলাই) বেলা ২টায় নগরীর মানিকপীর (রহ.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় তার প্রথম জানাযা শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার ফতেহপুরে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।

 

অপরদিকে, শুক্রবার রাতেও আখালিয়া, মদীনা মার্কেট, পাঠানটুলা, জিন্দাবাজার, কোর্ট পয়েন্ট, বন্দরবাজার এলাকায় দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।

 

দেশজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় শুক্রবার (১৯ জুলাই) দিবাগত রাত ১২টা থেকে সেনা মোতায়েন ও কারফিউ ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফায় শনিবার সকাল ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ ছিল। পরে ২ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বেলা ২টা থেকে দ্বিতীয় দফায় এবং রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়।

কারফিউ চলাকালে শনিবার (২০ জুলাই) সিলেটের কোথাও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেননি। নগরের রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল ছিল সীমিত। দোকানপাট, বিপনী বিতান, মার্কেট, অফিস-আদালত বন্ধ রাখা হয়। কেবল জরুরি সেবার আওতায় থাকা হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসী, অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশি যাত্রীবাহী যানবাহন, গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যবহৃত যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।

 

তবে ২৪ জুলাই থেকে কারফিউ শিথিলতার সময় বাড়লে সিলেটে সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বর্তমানে দিনের বেশিরভাগ সময় কারফিউ শিথিল করা হয় সিলেটে। ফলে সিলেটে জীবনযাত্রা পুরোটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। তবে সহিংসতা ঠেকাতে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল টিম চষে বেড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা এখনো মোতায়েন রয়েছে।

পুলিশ জানায়, কোটা সংস্কার ইস্যুতে সিলেটে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৭ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত মেট্রোপলিটন এলাকার কোতোয়ালি থানায় ৬, জালালাবাদ থানায় ৪ ও দক্ষিণ সুরমা থানায় ১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ১০টি মামলায় ২৪৪ জনের নামোল্লেখ করে ও অজ্ঞাত প্রায় ১৭ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো পুলিশ অ্যাসল্ট, সরকারি কাজে বাঁধা, বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি মামলার বাদী কুমারগাঁও বিদ্যুতকেন্দ্রের সহকারী পরিচালক (নিরাপত্তা) ও বাকিগুলোর বাদী পুলিশ।

সংবাদটি ভালো লাগলে স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন