আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: এ বছর বিশ্বখ্যাত ও সম্মানজনক ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার’ জিতেছে গাজার এক পঙ্গু ফিলিস্তিনি শিশুর হৃদয়বিদারক প্রতিকৃতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার বাস্তবতা ও মানবিক সংকটকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে এই ছবি।
ছবিটিতে দেখা যায়, নয় বছরের এক ফিলিস্তিনি শিশুর দুই হাতই গাজা সিটিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বোমার আঘাতে ছিন্ন ও বিকৃত হয়ে গেছে। এই ছবি বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করেছে, যা আরও একবার গাজার মানবিক সংকট এবং ফিলিস্তিনিদের দুঃসহ বাস্তবতা আন্তর্জাতিক মঞ্চের সামনে নিয়ে এসেছে।
পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ছবিটি তুলেছেন ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সামার আবু এলউফ।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ছবিটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ছবিতে দেখা যায়, দুই হাত হারানো মাহমুদ আজজুর নামের এক নয় বছরের ফিলিস্তিনি শিশুকে।
সাংবাদিক আবু এলউফ বলেন, মাহমুদের মা আমাকে যেসব কষ্টের কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছিল— যখন মাহমুদ বুঝতে পারে তার হাত নেই, তখন সে তার মাকে প্রথম বলেছিল; ‘আমি তোমাকে কীভাবে জড়িয়ে ধরবো মা?’
গত বছরের মার্চে গাজা সিটিতে এক ইসরায়েলি হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর মাহমুদ আজজুরকে চিকিৎসার জন্য কাতারের দোহায় সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই হামলা ছিল চলমান যুদ্ধে একটি ভয়াবহ পর্ব মাত্র। যেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫১ হাজার ২৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৪৩২ জন।
আলোকচিত্রী সামার আবু এলউফ নিজেও গাজার বাসিন্দা ছিলেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার পর তিনিও গাজা থেকে সরে যান। বর্তমানে তিনি কাতারের দোহায় অবস্থান করছেন। সেখানে আশ্রিত গুরুতর আহত ফিলিস্তিনিদের জীবন সংগ্রামের চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করছেন।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর নির্বাহী পরিচালক জুমানা এল জেইন খুরি বলেন, এটি একটি নীরব ছবি। কিন্তু এর আওয়াজ অত্যন্ত শক্তিশালী। এটি এক শিশুর গল্প বললেও, একইসঙ্গে এমন একটি যুদ্ধের গল্প বলে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রভাব ফেলবে।
ছবিটি সম্পর্কে প্রতিযোগিতার জুরি বোর্ড মন্তব্য করেছে, শক্তিশালী কম্পোজিশন এবং আলো ব্যবহারের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি ছবিটিকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। সেইসঙ্গে এর গভীর ও ভাবনা-জাগানো বিষয়বস্তু— বিশেষ করে, মাহমুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসে— তা ছবিটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
জুরি বোর্ড আরও মন্তব্য করেছে, ছবিটি কেবল একটি শিশুর দুর্দশা নয়, বরং ‘একটি গোটা অঞ্চলকে কীভাবে মানবতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে’ সেই বাস্তবতাও তুলে ধরে। একই সঙ্গে এটি গাজায় সাংবাদিকদের ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার বিষয় এবং যুদ্ধের বাস্তবতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে আগ্রহী আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার অস্বীকার করার নীতির বিরুদ্ধেও এক শক্তিশালী প্রতিবাদ।
বর্তমানে মাহমুদ তার পা ব্যবহার করে মোবাইলে গেম খেলা, লেখা এবং দরজা খোলার মতো কিছু কাজ শিখছে বলে জানিয়েছে জুরি। তবে খাওয়া, পোশাক পরা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কার্যকলাপে এখনও তার বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন হয়।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মাহমুদের স্বপ্ন খুব সাধারণ; সে কৃত্রিম হাত পেতে চায় এবং অন্য সব শিশুর মতো স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চায়।
বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থী ও দাতব্য সংস্থা (উএনআরডব্লিউঅ্যা)-এর সাম্প্রতিক হিসাব উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজায় বিশ্বের অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশি শিশু পঙ্গু হয়েছে।
এটি যুদ্ধের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে তুলে ধরে, যেখানে শিশুদের জীবনধারা ও ভবিষ্যৎ কাঁপিয়ে উঠছে। জুরি বোর্ডও এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে জানিয়েছে, যুদ্ধের প্রভাব শিশুদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি।
গত বছরও গাজার একটি মর্মস্পর্শী ছবি এই পুরস্কার জিতেছিল। ওই ছবিতে দেখা যায়, হাসপাতালের মর্গে হাঁটু গেড়ে বসে কোলে কাফনে মোড়ানো শিশুর লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন এক ফিলিস্তিনি নারী।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের মর্গের ওই ছবি ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর তুলেছিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ সালেম। ইসরায়েলের হামলায় গাজার হাজারো মানুষের মৃত্যু আর স্বজনদের আর্তনাদের চিত্র তুলে ধরে ওই বছরের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার পুরস্কার জিতেছেন তিনি।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা