সজল ছত্রী ::::
গত এক বছরে সিলেট সীমান্তে ৯ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বা ভারতীয় নাগরিকদের গুলিতে নিহত বাংলাদেশিদের হত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কারো কাছে কোনো খবর নেই। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
গুলিতে নিহত বাংলাদেশিদের মরদেহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিরো লাইন বা ভারতের অভ্যন্তরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক বা রাতের আঁধারে সীমান্ত এলাকার লোকেরা গোপণে মরদেহ দেশে নিয়ে আসেন।
গত ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে কিশোরী স্বর্ণা দাস নিহতের পর নতুন করে আলোচনায় আসে সিলেটের সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনা। নিরস্ত্র স্বর্ণা দাস পরিবারের সাথে দেখা করতে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।
আলাপকালে বিজিবি সিলেট সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জানান, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তবে সিলেট সীমান্তে হতাতের ঘটনার পেছনে রয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও ভারতের নাগরিকের সাথে অবৈধ লেনদেন একটি বড় কারণ। এজন্য সীমান্ত এলাকার অধিবাসীদের অবৈধভাবে দেশের সীমানা অতিক্রম না করার বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। নিয়মিত কাউন্সিলিং, সভা করছি।
হত্যার শিকার বাংলাদেশিদের পরিবারের দাবি, আক্রান্ত ব্যক্তিরা কাঠ সংগ্রহ, গরু চরানো বা কৃষিকাজ করার সময় সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় নাগরিক বা বিএসএফের আক্রমণের শিকার হন। তবে একাধিক সূত্র বলছে, দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার শক্তিশালী চোরাই সিন্ডিকেটের হয়ে ভারত থেকে চোরাইপণ্য পরিবহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন নি¤œ আয়ের এসব মানুষ। চোরাকারবারে জড়িত ভারতের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সাথে স্বার্থ নিয়ে বিরোধের জেরেও ঘটছে হত্যাকান্ড। নিহতদের অনেকেই কিশোর বা দিনমজুর।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় খাসিয়ারা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে কিছু বাংলাদেশি চোরাকারবারি। দুই পারের এই চোরাচালান চক্রের লোভের শিকার হচ্ছেন সীমান্তবর্তী হতদরিদ্র জনগণ। সামান্য অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে চোরাই পণ্য আনা-নেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত, চোরাকারবারি সিন্ডিকেটগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই সীমান্ত এলাকায় এসব হত্যার ঘটনা বাড়ছে। আর হত্যা হওয়া অধিকাংশ চোরাচালানের সাথে জড়িত।
মানবাধিকার কর্মী লক্ষ্মীকান্ত সিংহ জানান, সিলেট সীমান্তে হঠাৎ করে হত্যাকান্ডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগজনক। সীমান্তবর্তী মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে দিলে এটি বন্ধ হবে না। সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধে আমরা প্রায়ই বিএসএফ-বিজিবির বৈঠক হতে দেখি। কিন্তু এ সুফল দেখা যাচ্ছে না। হত্যাকান্ড বন্ধে বিএসএফ তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না বলে মনে করেন তারা। সীমান্তে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বিএসএফের।
সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বড় কেয়ারা সীমান্ত এলাকায় জহুর আলী (৬০) নামের বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর আগে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় সীমান্তের ভেতরে মাসুম আহমদ (১৫) নামের বাংলাদেশি কিশোরের গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। ১৪ জুলাই ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে ভারতীয়দের গুলিতে মারা যান সুনামগঞ্জের দয়ারবাজারের কাউছার আহমেদ। একই দিনে সিলেট সীমান্তে হত্যা করা হয় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের আলী হোসেনকে। ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৩ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহতের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।
২৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভুলক্রমে সীমান্ত অতিক্রম করা শেখ ফরিদকে হত্যা করে ভারতীয়রা। ৬ নভেম্বর সীমান্তে হত্যার শিকার হন জৈন্তাপুরের জমির উদ্দিন। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় নাগরিকদের গুলিতে মৃত্যু হয় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ গ্রামের আশরাফ উদ্দিনের। ২৭ ডিসেম্বর সিলেটের দমদমিয়া সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে নিহত হন সবুজ মিয়া (২২)। তার একদিন আগে ২৬ ডিসেম্বর মিনাটিলায় এলাকায় একইভাবে প্রাণ হারান মো. মারুফ মিয়া (১৬) নামের এক কিশোর।
পাহাড়-টিলা ও দুর্গম অঞ্চলঘেরা সিলেট সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মানবপাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠছে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র। তাদের সাথে যুক্ত হয়ে চোরাকারবারিরা এই সীমান্ত দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রতি মাসে দেশে আনছে হাজার কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের কয়েক বছরে এই রুটে শুধু চিনি পাচার করেই রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যান আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। এই হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যের বলি হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার নি¤œ আয়ের মানুষ। কর্মসংস্থানের অভাব ও বাড়তি টাকার লোভে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ভারত থেকে অবৈধ পথে পণ্য পরিবহণে যুক্ত হচ্ছেন তারা।
ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে পণ্য আনার কাজে সরাসরি যুক্ত একাধিক ব্যক্তি দাবি করেন, জীবিকার অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চোরাই পণ্য পরিবহণের কাজ করে থাকেন তারা। নির্দিষ্ট পণ্য সীমান্ত পার করে দেওয়া তাদের দায়িত্ব। ভারত থেকে গরুর মাংস, গবাদিপশু, ইয়াবা, চিনি, কাপড়, কসমেটিকস যেমন আসে, বাংলাদেশ থেকেও পাচার হয় রসুন, দেশি মাছসহ নানান পণ্য।
নি¤œ আয়ের এসব মানুষের দাবি, দীর্ঘ দিন তারা সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাথর উত্তোলন ও পাথর বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন। পরিবেশ রক্ষায় পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় তারা কোনো কাজ নেই।
তারা বলেন, অনেক সময় ভারতের খাসিরায়া গুলি করে। তখন কিছু করার থাকে না। বিএসএফের হাতে পড়লে সেটাও মরার সমান। তারা এমনভাবে নির্যাতন করে যে, ফিরে এসে কেউ আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। তবে বিজিবি তাদের নির্যাতন করে না। বিজিবিকে দেখতে তারা মালামাল ফেলে পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যান।
মাদক ও অস্ত্র পাচারেরও বড় রুট সিলেট। আসছে রহস্যজনক প্রযুক্তিযন্ত্রও। গত ২৪ ডিসেম্বর বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন বিওপির জোয়ানরা অভিযান চালিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার মালামাল জব্দ করে। এসব মালামালের মধ্যে ছিলো ইন্টারনেট-প্রযুক্তির রিপিটার, ডুপ্লেক্স ও রেডিও সেট।
প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এধরনের ডিভাইস উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন, ইন্টারনেটহীন এলাকায় সংযোগ ও ইন্টারনেট জ্যাম্যারসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অবৈধ কল সেন্টার এবং ফোন নাম্বার ক্লোনিংয়ের কাজেও ব্যবহার করা যায় ডিভাইসগুলো।
রহস্যজনক যন্ত্র নিয়ে বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান (পিএসসি) বলেন, ডিভাইসগুলো অত্যাধুনিক। আমরা পরবর্তীতে সেগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছি। এসব ডিভাইস কারা নিয়ে আসছে, কী উদ্দেশ্যে আনছে, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই রুট ব্যবহার করেই অবৈধভাবে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা। অনেকে দালালদের মারধর ও ছিনতাইয়ের শিকার হন। পাহাড় ডিঙিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকে মারাও যান।
বিজিবি সিলেট সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সিলেটের ৩০২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্যে চা বাগান, নদী, পাহাড় ও টিলা আছে। অনেক এলাকা দুর্গম। তবে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গত এক বছরে সিলেট ব্যাটালিয়নই চিনি, মাদকসহ প্রায় তিনশ কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ করেছে। অল্প কিছু হলেও চোরাকারবারিকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া অনুপ্রবেশকারী বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়েছে।
সিলেটের বাংলাবাজর, তামাবিল, শ্রীপুর, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারসহ কয়েকটি সীমান্তে রাতের বেলা চোরাচালানের প্রবণতা বেশি। সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা প্রায়ই বিজিবির ওপর হামলার চেষ্টা করে জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে সমন্বিতভাবে চোরাচালান প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত একছরে সবচেয়ে বেশি ৫জন প্রাণ হারিয়েছেন বিজিবির ৪৮ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বাধীন এলাকায়। বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো. হাফিজুর রহমান জানান, গোয়াইনঘাট সীমান্তে নিহত সবুজ ও মারুফ সহযোগীদের সাথে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল। দ্বন্দ্বের জের ধরে তারা ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনায বিএসএফ-৪ এর কমান্ড্যান্ট এর সাথে আলোচনা করে হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ এবং এ ঘটনার সাথে জড়িত ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের তামাবিল সীমান্তের ওপারে ভারতে ডাউকি এলাকা থেকে বাংলাদেশের ১৩ নাগরিককে আটক করে বিএসএফ। ওই ১৩ জনও চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে বিজিবির কাছে দাবি করেছে বিএসএফ। অন্যদিকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই চার ভারতীয়কে আটক করে বিজিবি।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা