যুগভেরী ডেস্ক ::: অনেকটা গ্রিক উপকথার সেই ফিনিক্স পাখির গল্পের মতো। ২০২৪ সালের শুরুতে নির্বাচন বর্জন করায় মামলা-হামলা-নির্যাতনের অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। আত্মগোপনে চলে যান কেন্দ্রীয় নেতারা; ঘরছাড়া হয় তৃণমূল। এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই ঘটে যায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব। মুহূর্তেই বদলে যায় দৃশ্যপট। রাজনীতিতে কোণঠাসা বিএনপি বছর শেষে চলে যায় ড্রাইভিং সিটে।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন মাঠে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ২০২৪ সাল শুরুর মাস দুয়েক আগে বেশ বেকায়দায় পড়ে। সরকারের গ্রেফতার অভিযানে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ান তারা। বলা যায়, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে বিএনপি। সিনিয়র গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জেলে রেখে দ্বাদশ নির্বাচন করে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার। ভোটের আগে ও পরে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বিএনপি। যদিও ভোট বর্জনের বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছিল দলটি। ভোটের পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি। একে একে কারামুক্ত হন নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনা সরকার সহজেই উপজেলা নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে যায়। বহিষ্কার করেও দলীয় নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঠেকাতে পারেনি বিএনপি।
রাজনীতির মাঠে একক নিয়ন্ত্রণ চলে আওয়ামী লীগের। জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে। যেখানে ছাত্রদের ব্যানারে মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিএনপি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে দলটি ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ৬ আগস্ট থেকেই রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। পুরোপুরি মুক্তি পান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একেবারে অনুপস্থিত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এ সুযোগে মাঠ দখল করে নেয় বিএনপি। প্রতিদিন জেল থেকে মুক্তি পেতে থাকেন নেতাকর্মীরা। পল্টন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিশাল জমায়েতে বাধাহীন সমাবেশ করে দলটি। বড় প্রায় সব সমাবেশে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। মহানগর, জেলা-উপজেলা ও থানায় নতুন কমিটি দেয় দলটি। সরকারে না থাকলেও জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে বিএনপি সমর্থিত কর্মকর্তারা সামনে চলে আসেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিএনপিপন্থিরা সরব হয়ে ওঠেন। ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, দখলদারি, ভাঙচুর ও মামলা বাণিজ্যের বদনাম জোটে বিএনপির নামে। টাকার বিনিময়ে স্থানীয়ভাবে পতিত আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ ওঠে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ভাবমূর্তি রক্ষায় কঠোর হয় বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার হুঁশিয়ারিও দেন। কেন্দ্রীয়ভাবে ১ হাজার ৩১ নেতাকে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ২০৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
যেভাবে মুক্ত খালেদা জিয়া : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর সবচেয়ে বড় ঘটনা বন্দিদশা থেকে খালেদা জিয়ার পুরোপুরি মুক্তি। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত থাকলেও এবার সরকার পতনের এক দিন পর সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করেন। মুক্তির পরপর নয়াপল্টনের সমাবেশে অনলাইনে বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনায় উপস্থিত হন খালেদা জিয়া।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। তিনি তখন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে ছিলেন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাহী ক্ষমতায় খালেদার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন খালেদা জিয়া। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। এরপর থেকে পরিবারের আবেদনে প্রতি ছয় মাস পরপর বিএনপি নেত্রীর মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আসছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিবারই তাকে দুটি শর্ত দেওয়া হচ্ছিল। তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পরিবারের তরফ থেকে বেশ কয়েকবার আবেদন করা হলেও ওই শর্তের যুক্তি দিয়েই বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছে শেখ হাসিনার সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে বছরের একেবারে শেষ দিকে উন্নত চিকিৎসায় লন্ডন যেতে পারেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সময়ের আলোকে বলেন, ম্যাডামের নামে ৩৭টি মামলা ছিল। ৫ আগস্টের পর বেশিরভাগ খারিজ হয়ে গেছে। সাজাও বাতিল করা হয়। ছোটখাটো দুয়েকটি মামলা হয়তো আছে, যা গুরুতর কিছু নয়। উনি আইনগতভাবে সম্পূর্ণ মুক্ত। নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই।
দেশে ফেরার অপেক্ষায় তারেক রহমান : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। সপরিবারে ঢাকা ফিরে তিনি গুলশানের একটি বাসায় উঠবেন। ইতিমধ্যে তার থাকার জন্য তিনটি বাসাও দেখা হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলাগুলো মোকাবিলা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মানহানির মামলা খারিজ হয়েছে। এখনও মানহানির ২৪টি মামলা রয়েছে। এগুলো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া চারটি মামলায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত। সেগুলোরও শিগগিরই শুনানি হবে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সময়ের আলোকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে ফিরবেন, তা তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে তার দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলা করা হয়। পরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সময় দুটি ক্রিমিনাল মামলাসহ মোট ৬৪টি মানহানির মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৫টি মামলায় তাকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ২১ আগস্টের মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। সবমিলিয়ে এখন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৪টি কনভিকশনের মামলা এবং ২৪টি মানহানির মামলা বিদ্যমান। এ মামলাগুলো আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করা যায়, দ্রুতই এগুলো শেষ হয়ে যাবে।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান তিনি। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা