যুগভেরী ডেস্ক ::: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একেবারে শেষে এসে কেন্দ্র করে থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। লুট হয় পুলিশের কয়েক হাজার অস্ত্র ও কয়েক লাখ গোলাবারুদ। এসব অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার জন্য হুমকিস্বরূপ। এজন্য অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে মাঠে নামছে যৌথ বাহিনী।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে শুরু হবে এ অভিযান। গত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ২৫ আগস্ট স্থগিত করে অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) শেষ হতে যাচ্ছে সব ধরনের লাইসেন্স করা ও লুট করা অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা। যারা পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র জমা দেবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণে চোরাচালানে সম্পৃক্ত গডফাদারদেরও ধরা হবে।
ঢাকাসহ সারা দেশের থানা-ফাঁড়ি থেকে কী পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে সে বিষয়ে পরিসংখ্যান মঙ্গলবারের পর জানানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার, স্থগিত করা কিন্তু জমা দেওয়া হয়নি এমন অস্ত্র জব্দ এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ এর কারবারি ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে গণআন্দোলনে রূপ নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাদের কাছে অস্ত্র দেখা গেছে, অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করেছেন এবং অস্ত্র মামলার আসামিদের ছাড় দেওয়া হবে না।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, যৌথ অভিযানে থাকছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং র্যাব।
আমাদের এখানে অভিযান তো রাত থেকেই শুরু হচ্ছে। এই অভিযানে অস্ত্র মামলার আসামি, বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারী, অবৈধ অস্ত্রের কারবারি ও ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।- মোছা. শাহনাজ বেগম, জেলা প্রশাসক, রংপুর
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অস্ত্র হাতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। হতাহতের ঘটনায় বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যেমন হয়েছে তেমনি দেখা গেছে অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শন। আন্দোলনকালে এ সংক্রান্ত অসংখ্য ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
যে কারণে অভিযান
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়েই বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দেখা গেছে। বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের প্রদর্শন করতেও দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সময় ছড়িয়ে পড়ে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিনদিন রাজধানীসহ দেশজুড়ে প্রায় পাঁচশ থানায় হামলা হয়। লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের যানবাহন। এসব ঘটনায় পুলিশের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীসময়ে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সব থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে পুলিশ এখনো পুরোপুরি কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
একটি সূত্র জানায়, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে দশ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে। এদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
যেভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, স্থগিত করা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে উদ্ধার অভিযানে সেগুলো জব্দ করা হবে। একই সঙ্গে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেহাত হওয়া ও হারানো অস্ত্রসহ যে কোনো অবৈধ অস্ত্র এ অভিযানে উদ্ধার করা হবে।
সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসারের যৌথ সমন্বয়ে অপারেশন টিম গঠন করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। মহানগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করবেন পুলিশ কমিশনার। সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় কমিশনার এ অভিযান পরিচালনা করবেন।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কোর কমিটির মাধ্যমে স্থগিত করা লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হবে। এই কমিটিতে পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং অন্য বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।
সারা দেশের থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে তার পরিসংখ্যান তৈরির কাজ চলছে। আশা করছি শিগগির জানিয়ে দিতে পারবো।- ইনামুল হক সাগর, এআইজি, পুলিশ সদর দপ্তর
এছাড়া অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ বা হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিস প্রচার করবে।
এখন পর্যন্ত যত অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৩৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, ২২ হাজার ২০১ টিয়ার শেল এবং ২১৩৯ সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে এক হাজার ৮৯৮টি অস্ত্র লুট করা হয়। এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৪৪৫টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, লাইসেন্স স্থগিত করা এমন অস্ত্র জমা পড়েছে ৩৫টি, সঙ্গে ১ হাজার ১৬৯ রাউন্ড গুলি।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে ডিএমপির সমন্বয় সভা
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে অভিযানে নামছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ আনসারের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী।
যৌথ বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসানের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) ডিএমপি সদর দপ্তরে এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সমন্বয় সভায় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ আনসারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অস্ত্র উদ্ধারে মহানগর ও জেলায় আলাদা সমন্বয় টিম গঠন
অস্ত্র উদ্ধার, অবৈধ অস্ত্র কারবারি ও এর অবৈধ ব্যবহারকারীদেরও ধরা হবে। বিশেষ করে অবৈধ অস্ত্র কারবার ও ব্যবহারে অস্ত্র মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর।
রংপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ভারপ্রাপ্ত) মোছা. শাহনাজ বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমন্বয় সভা করেছি। আজকের মধ্যে যারা অস্ত্র, গোলাবারুদ জমা দেবেন তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু যারা দেবেন না বা দেননি সেটার তালিকা করা হবে। সেটা নিয়ে আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে বৈঠক করবো। সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হবে।’
তিনি আরও বলেন, অভিযান তো রাত থেকেই শুরু হচ্ছে। এই অভিযানে অস্ত্র মামলার আসামি, বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারী, অবৈধ অস্ত্রের কারবারি ও ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘সারা দেশের থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে তার পরিসংখ্যান তৈরির কাজ চলছে। আশা করছি শিগগির জানিয়ে দিতে পারবো।’
এ ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে। শেষ তিনদিন (শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে-পরে) থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়।’
তিনি বলেন, ‘গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জারি করা প্রজ্ঞাপনে বিগত ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত স্থানে আগ্নেয়াস্ত্র জমা না করলে তা অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে। তাছাড়া, কোনো ব্যক্তির কাছে পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলা-বারুদ রক্ষিত থাকলে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আপনারা জানেন আজ কিন্তু অবৈধ ও বৈধ সর্বস্ত জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাত ১২টা থেকে যৌথ বাহিনীর অপারেশন শুরু হবে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য।
মাদকের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাদক আমাদের একটি বড় ধরনের সমস্যা, এটি আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? এজন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। যাতে মাদকদের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে পারি।সূত্র : জাগোনিউজ
সংবাদটি ভালো লাগলে স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন