সজল ছত্রী:::
গত তিন শতকে সিলেটের প্রায় ৪০ শতাংশ টিলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পরিবেশকর্মীরা এমন দাবি করলেও প্রশাসনের কাছে নেই সিলেটের টিলা-পাহাড়ের প্রকৃত সংখ্যা বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার টিলার হিসাব। সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান দাবি করেছেন, কোথাও টিলা কাটার খবর পেলে নিয়মিত অভিযান করে শাস্তি ও জরিমানা করা হয়। অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তরও। সিলেটে টিলাকাটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেন তিনি।
তবে প্রশাসনের ‘নিয়মিত অভিযান’ বাধা হতে পারেনি টিলা কাটায়। গত কয়েকদিনে সিলেট নগরীর আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অন্তত দশটি টিলা কেটে সমতল করার কাজ চলছে। নগদ অর্থের বিনিময়ে পরিবেশ ধ্বংসের এই কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। কোথাও রাতের আঁধারে, কোথাও প্রকাশ্যেই ঘর তৈরির বাহানায় কাটা হচ্ছে টিলা পাগাড়।
অনেক টিলার মালিকানা নিয়ে চা বাগান, বন বিভাগ বা জেলা প্রশাসনের সাথে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির দ্বন্দ্ব আছে। সেই সুযোগে গৃহহীন দ্ররিদ্র মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছে অল্প টাকায় টিলার জমি বিক্রি করছেন প্রভাবশালীরা। পরে তাদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে দফায় দফায় কাটছেন টিলাভূমি।
নগরীর বালুচর, মেজরটিলা, হাওলদারপাড়া, ব্রাহ্মণশাসন, কালিবাড়ি, আখালিয়া, দুসকি, নালিয়া, সদর উপজেলার সাহেববাজার, খাদিমনগর ছাড়াও গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জৈন্তাপুর উপজেলায় দেদারসে চলছে টিলা কাটা। পাথর উত্তোলনের নামে টিলা কেটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন নামে একটি বিশাল টিলা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। নগরীর ভেতরে সবচেয়ে বড় মজুমদার টিলা সাবাড় করে তৈরি হয়েছে আবাসিক এলাকা।
এছাড়া তারাপুর, মালনীছড়া, লাক্কাতুরা, দলদলি, আলীবাহারসহ নগরীর আশেপাশের সব চা বাগানেই নির্বিচারে পাহাড়-টিলা ধ্বংস করা হচ্ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব টিলা-পাহাড় পানির রিজার্ভ ধরে রাখার পাশাপাশি ভূমির ওজনের ভারসাম্য ধরে রাখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ডেঞ্জার জোনে অবস্থানকারী সিলেটে নির্বিচারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে।
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলমের মতে, সিলেট বন্যা এবং ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জলাবদ্ধতাও এখানে প্রকট হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পাথর-মাটির টিলাগুলো একদিকে যেমন পানি রিজার্ভ করে রাখে অন্য দিকে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ভূমিকা রাখে। টিলা কাটার ফলে ভূমির সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, সিলেট নগরীর ভেতরেও অনেকগুলো টিলা কেটে সাবার করা হয়েছে। টিলাগড় এলাকায় টিলা কাটায় নেতৃত্ব দিয়েছে সরকারি দপ্তর। সেখানে সরকারি ভবন হচ্ছে। এছাড়া আরও অনেক টিলার মালিকানার দাবি নিয়ে কিছু ব্যক্তি আদালতে আবেদন করে রেখেছেন। এ নিয়ে মামলা চলমান অবস্থায় অসহায় ও দ্ররিদ্র মানুষের কাছে টিলার জমি বিক্রি করে তাদের দিয়ে টিলা ধ্বংস করাচ্ছেন।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, অভিযোগ পেলে হয়ত অভিযান চালায় প্রশাসন। কিছু মাটি কাটার যন্ত্র জব্দ বা জরিমানা করা হয়। কিন্তু কদিন পর আবারও আগের মত চলতে থাকে মাটি কাটা।
সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নে সিলেটের প্রথম চা বাগান মালনিছড়া ও আলীবাহারের মধ্যবর্তী টিলাময় একটি এলাকায় কাটা হচ্ছে অন্তত ছয়টি টিলা। টিলা কেটে জাহাঙ্গির নগর নামে রীতিমতো আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। অর্ধেক কাটা টিলার নিচে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন অনেক পরিবার। বর্ষা মৌসুমে এসব টিলায় ধ্বস দেখা দিলে প্রাণনাশের ঝুঁকি রয়েছে।
কর্তিত কয়েকটি টিলার মালিকানার দাবিদার দিলওয়ার খান নামে এক ব্যক্তি। এনিয়ে মামলা চলছে আদালতে। দিলওয়ার খানের ছেলে কবির খান দাবি করেন, তাদের জমির পাশে চা বাগানের টিলা কারা কাটছেন তা তিনি জানেন না। তবে বারবার আবেদন করায় কিছু গরিব মানুষকে তিনি সেখানে থাকতে দিয়েছেন। তারা থাকার ঘর ও রাস্তা তৈরির জন্য কিছু মাটি কেটে থাকতে পারেন। তবে কাউকে তিনি এখানে থাকার জন্য ডেকে আনেননি।
এই এলাকায় টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। আলাপকালে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবিব মিয়া বলেন, জাহাঙ্গিরনগর এলাকায় যারা বসবাস করেন তারা সবাই গরিব। তাদের চলাচলের সহায়তার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে।
টিলা কেটে কেন আবাসন করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাস্তার জন্য সামান্য কিছু মাটি কাটা হচ্ছে।
টিলাকাটার কৌশল হিসেবে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের ফলে বর্ষা মৌসুমে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। গত বছর টিলা ধ্বসে প্রাণ গেছে অন্তত পাঁচজনের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র দেওয়া তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় একসময় কয়েক হাজার টিলার অস্তিত্ব ছিল। যার অধিকাংশই কেটে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে প্রশাসনের তেমন কোনো নজরদারি নেই। তাদের তথ্যমতে, সিলেটের ছয় উপজেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে নগর ও উপকণ্ঠ মিলিয়ে সিলেট সদর উপজেলায় ১৯৯টি, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ৪১৩টি, বিয়ানীবাজারে ২৭০টি, জৈন্তাপুরে ৯৮টি, গোয়াইনঘাটে ৪৪টি ও কোম্পানীগঞ্জে একটি টিলা ছিল। যার অনেকগুলো পুরোপুরি কিংবা আংশিক সাবাড় হয়ে গেছে।
গত তিন বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় ও টিলা কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে প্রায় তিন কোটি টাকা। পাশাপাশি ২১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে এটি যথেষ্ট নয় দাবি করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বলেন, গত বর্ষা মৌসুমে এক মাসে পৃথক টিলা ধসে পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরকম ঘটনা ঘটলে কিছু দিন তৎপর দেখা যায় প্রশাসনকে। কিন্তু তারপর আবার সব আগের মত চলতে থাকে।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে সিলেটে সব ধরনের টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ রয়েছে। তবে তাতে বন্ধ হয়নি টিলা কাটা।
সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : নূরুর রশীদ চৌধুরী, সম্পাদক : ফাহমীদা রশীদ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক : ফাহমীনা নাহাস
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : অপূর্ব শর্মা