মাহবুবুর রহমান
বৃহষ্পতিবার, ২৭ এপ্রিল ‘২৩। দুই প্রান্তে দু’জন, নিউইয়র্কে আমি (মাহবুবুর রহমান), ওপারে মালিক ভাই (আব্দুল মালিক চৌধুরী, ইত্তেফাকের সাবেক সিলেট বুরো প্রধান)। পয়ত্রিশ বছর পর ফোনালাপ। ব্যবস্থাটা লোকমানের (জাসদ নেতা লোকমান আহমদ)। আগের দিন জানিয়ে রেখেছিলেন। আমি আনন্দে উদ্বেলিত।
কতক্ষণ কথা হয়েছিলো? দু’ঘন্টা? তারও বেশী। কথা আর শেষ হয় না। আমার ক্লান্তি ধরা পড়ে মালিক ভাইর কাছে। বললেন, মাহব্বু সাহেব অসুস্থ, আজ এ পর্যন্ত থাক। সিলেটে মধ্যরাত, নিউইয়র্কে তখন দুপুর। মালিক ভাইর পাশে লোকমান আহমদ আর আমার পাশে আব্দুল ওয়াহিদ টুপন (মদিনার আলো সম্পাদক, আমাকে দেখতে এসেছেন এক ঝুড়ি ফলমূল নিয়ে।) তারাও উপভোগ করলেন আমাদের উচ্ছাস।
ইব্রাহিম চৌধুরী এক ধাপ এগিয়ে। ফোনালাপের স্ন্যাপ শট আমার ম্যাসেঞ্জারে পাই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে। শ্মশ্রুমন্ডিত নিজের ছবি দেখে অবাক হই।
সত্তর-আশির দশক। নয়নাভিরাম পৌর পাঠাগার ছিল সাংবাদিকদের আড্ডার প্রিয় স্থান। এর প্রধান কারণ লোকেশন। সামনে সুরমা নদী, পাশে ঐতিহাসিক কীনব্রীজ, চাঁদনী ঘাট, আলী আমজদের ঘড়ি, সারদা হল। আগে এটা ছিল লোকনাথ টাউন হল। আসাম টাইপের সুন্দর বাড়ী। সামনের প্রশস্থ প্রাঙ্গণে সুশোভিত ফুল। নদীতে বয়ে যায় নানা রঙের, নানা সাইজের নৌকা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদস্পর্শে ধন্য এ হল। সিলেট সফরকালে এখানে নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছিলেন।
সাংবাদিকদের আকর্ষণের আরেক বড় কারণ, মালিক ভাই। সে সময় প্রেসক্লাব ছিল, ঘর ছিল না। আড্ডার সীমিত কয়েক স্থানের মধ্যে যুগভেরী, জেলা তথ্য অফিস আর পৌর পাঠাগার। মধ্য সত্তরে ঢাকার দৈনিক ও সংবাদ সংস্থায় সিলেটে যারা কাজ করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন তবারক হোসেইন, মাহবুবুর রহমান, আব্দুল মালিক চৌধুরী,বোরহান উদ্দিন খান, অজয় পাল, আব্দুল ওয়াহেদ খান, সুধীন্দ্র বিজয় দাস সলুদা, রফিকুর রহমান লজু, ডাঃ দিলওয়ার রানা, এম এ রব, বাবরুল হোসেন বাবুল, মুকুল আশরাফ, ইকবাল কবির, বুদ্ধদেব চৌধুরী, শামসুল হক চৌধুরী, সুবিনয় কুমার দাস প্রমূখ। বিপিআই সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন এক তরুণ, নাম মনে আসছে না।(কারো নাম বাদ পড়লে তা একান্ত অনিচ্ছাকৃত)। সন্ধ্যায় আমরা ব্যস্ত থাকতাম ঢাকায় খবর পৌছাতে। প্রায়ই ঢু মারতাম পাঠাগারে। ওখানে অন্যরাও আসতেন। সাংবাদিক সমিতির সভাও মাঝে মধ্যে হতো। মালিক ভাই ছিলেন সংগঠনের সম্পাদক। প্রেসক্লাবের বেশীরভাগ সভা হতো ‘জ্যোতি মঞ্জিলে’। সভাপতি ছিলেন আমীনূর রশীদ চৌধুরী। বাড়তি আকর্ষণ ছিল জ্যোতিমঞ্জিলের আতিথেয়তা।
পৌর পাঠাগারের হলরুম বেশ বড়। পরিবেশ শান্ত, নির্মল। কোন কোলাহল নেই। পাঠকরা সবাই পাঠে মগ্ন। পূর্ব পাশে গ্রন্থাগারিকের রুম। এ রুমটিও বেশ বড়। রুমের অর্ধেক অংশে আরামদায়ক সোফা বসানো। আমরা ওখানটায় আড্ডা দিতাম, কাউকে ডিস্টার্ব না করে। মালিকভাই কাজের ফাকে ফাকে সঙ্গ দিতেন। প্রেসক্লাবের স্বাদ খানিকটা এ ভাবেই মিটতো।
মালিক ভাইর সাথে কথা হয়নি দেশ ছাড়ার পর । কত বছর? পয়ত্রিশ বছর। জমা কত কথা, কোনটা রেখে কোনটা বলি। আমার কথা শেষ করি এক কথায়, এখন গৃহবাসী। মালিক ভাই বললেন তাঁর কথা। এক মেয়ে, এক ছেলে। দু’জনই শিক্ষিত। মেয়ে ডাক্তার। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের পাশে এক টুকরো জমি কিনে বাড়ী করেছেন। সম্ভব হয়েছে কুলাউড়ায় পৈতৃক জমি বিক্রয় ও ব্যাংক লোন। ইত্তেফাকের সিলেট বুরো প্রধান ও প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
তাঁকে বললাম, ২০১৮ সালে প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। সুদৃশ্য ভবন। এক ঝাক তরুণ মুখ। ভালো লেগেছে। সভাপতি ইকরামুল কবির, কিশোর বয়সে দোখেছি যুগভেরীতে। সময় টিভির সাংবাদিক। সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ। একাত্তর টিভির সাংবাদিক। ইকবাল বললেন, আপনার রুম দেখবেন না?
আমার রুম! কিছুটা অবাক হলাম।
ইকবাল নিয়ে গেলেন সাধারণ সম্পাদকের কক্ষে। বললেন, আপনিতো সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এবার বুঝলাম। রুমে যতক্ষণ ছিলাম, সুন্দর এক অনুভূতি আমাকে সিক্ত করলো।
মালিক ভাইকে বললাম, আপনার উপর যে বইখানি প্রেসক্লাব প্রকাশ করেছে, ইকবাল তা আমাকে দেখিয়েছেন। সুন্দর ছাপা, অঙ্গসজ্জা। পুরোটা পড়া হয়নি। খুশী হয়েছি প্রেসক্লাবের এমন কাজে। ইকবাল মাহমুদ তখন তার এক অভিজ্ঞতা উল্লেখ করলেন। মালিক ভাইর সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে বার বার তিনি ‘মাহবুব সাহেব’ নামটি উচ্চারণ করছিলেন। তখনই আমার আগ্রহ জন্মে, কে এই মাহবুব সাহেব, তাঁকে জানা দরকার। আজ সে ইচ্ছা পূরণ হলো।
পাঠাগারের আড্ডায় আলোচনা হতো প্রেসক্লাব নিয়ে। এখনো ক্লাবের ঘর হলো না। নির্বাচনেরও খবর নেই। একই কমিটি দেখছি অর্ধযুগ ধরে। সাধারণ সম্পাদক কেন নির্বাচন দিচ্ছেন না?
সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমীনূর রশীদ চৌধুরী। ‘৭৩ সালে যুগভেরীতে যোগদানের পর তবারক ভাই (সাধারণ সম্পাদক) আমাকে বললেন, প্রেসক্লাবের কমিটিতে আমাকে নেয়া হয়েছে। জ্যোতি মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত ক্লাবের সভায়ও উপস্থিত থেকেছি। সে সব সভায় জনশক্তি সম্পাদক নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী ও দেশবার্তা সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধরও অংশ নিয়েছেন। অনেক পরে আমীনূর রশীদ চৌধুরী প্রেসক্লাবের কার্যক্রম থেকে কিছু দিনের জন্য নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এর কারণ পরে জানতে পেরেছি। এক রাজনৈতিক দলের জঙ্গী কর্মী (হবিগঞ্জ বাড়ী) সাংবাদিকের পরিচয়ে ক্লাবের আঙ্গিনায় প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। তার অভদ্রোচিত আচরণে সদস্যরা বিরক্তি প্রকাশ করতেন। ক্লাবের এমন পরিবেশে থাকতে চাননি জনাব চৌধুরী। পরে সাংবাদিকরা ওই জঙ্গী কর্মীকে বহিষ্কার করে ক্লাবের পরিবেশ রক্ষা করেন।
মনে পড়ে, ‘৭৩ সাল থেকে সিলেটে নতুন ডিসি অথবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কেউ এলে তবারক ভাইর নেতৃত্বে আমরা দেখা করে প্রেসক্লাবের জন্য জমি বা ঘরের আবেদন করতাম। এ ভাবেই চলেছে বছরের পর বছর। এমনকি তবারক ভাইর নেতৃত্বে জিন্দাবাজারের অফিসে গিয়ে দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে বাকশালে যোগদান করেছি। সবাই আশ্বাস দিয়েছেন ঘর-জমির, তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘৭৮ পর্যন্ত। উল্লেখ্য, আমীনূর রশীদ চৌধুরী বাকশালে যোগদান করেন নি।
‘৭৮ সাল। পাঠাগারের আড্ডার হালকা আলোচনা দিনে দিনে ভারী হতে থাকলো। ক্লাবের জমি-ঘর হয়নি, ঠিক আছে, নির্বাচন করতে বাঁধা কোথায়? অর্ধযুগের উপরে একই কমিটি! সাধারণ সম্পাদকের উচিত নির্বাচন আয়োজন করা। এ সব আড্ডায় আরো আসতেন ক্লাব সদস্য ফজলুল করিম চৌধুরী অপু, এহিয়া রেজা চৌধুরী, খালিসুর রহমান, এটিএম হায়দার, আলী আশরাফ চৌধুরী খালেদ প্রমুখ। এক পর্যায়ে বিষয়টি আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করা হয় অর্থাৎ কার্যকরী কমিটির সভা ডেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ আসে । চূড়ান্ত পর্যায়ে কার্যকরী কমিটির সভায় নতুন একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়–যার সভাপতি বোরহান উদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। দু’জন ছাড়া কমিটির সকল সদস্য সভায় উপস্থিত ছিলেন। সে দু’জন হচ্ছেন তবারক হোসেইন ও অজয় পাল। বোরহান উদ্দিন খান থাকতেন গ্রামের বাড়ী বালাগঞ্জে। দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি ছিলেন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শহরে চলে আসেন।
এরপর ঘটে নাটকীয় ঘটনা। যে দিন আমরা নতুন কমিটি করি সে দিন বা পরদিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ফয়েজউল্লা শহরের সুবিদবাজারে প্রেসক্লাবের জন্য এক খন্ড জমি বরাদ্দ করেন এবং বরাদ্দপত্র তবারক ভাইর কাছে হস্তান্তর করেন। এ খবর সত্যি আনন্দের। আমরা সুবিদবাজারে সরজমিনে দেখে জমির দখল সমঝে নিলাম। জেলা প্রশাসক ভবন নির্মাণের জন্য ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিলেন ( সে সময় এটা অনেক টাকা)। ক্লাবের নির্মাণযজ্ঞ শুরু হলো। ইট,পাথর, বালি, সিমেন্ট, রড আনতে হবে। আমি পড়লাম বিপদে। দু’টি পত্রিকায় (যুগভোরী ও সংবাদ) চাকুরী করি, ফুলটাইম। বাংলাদেশ বেতারে কথিকা ও স্ক্রিটও লিখি। এতসব করে ক্লাবের ভবন নির্মাণের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব কি ভাবে করবো। এতে কোন কাজই হবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে দাঁড়াবো। কার্যকরী কমিটি তখন এহিয়া রেজা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিল। তাঁর এ সব কাজে অভিজ্ঞতা ও সময় দু’টোই আছে। এহিয়া রেজা চৌধুরীর তত্বাবধানে ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলো। প্রেসক্লাব তখন এক বাস্তবতা।
মালিক ভাই স্মরণ করলেন, নতুন কমিটি গঠনের পরদিন তবারক ভাই সলুদাকে সঙ্গে নিয়ে পাঠাগারে আসেন এবং ক্লাবের জমির জেলা প্রশাসকের বরাদ্দ পত্রটি তার কাছে হস্তান্তর করেন।
ভাবলাম, একদিন আগে এটা এলে প্রেসক্লাবের ইতিহাস কিঞ্চিত পরিবর্তন হতো। আজকে যেমনটা লিখছি, তেমনটি না।
আমাদের কথোপকথন দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশে মধ্যরাত গড়িয়েছে। বুঝতে পারি, ইদানীং আমার ফোনালাপ দীর্ঘ হচ্ছে। আগে ছিল তার উল্টো। এইতো ক’দিন আগে, লোকমানের ফোন ছাড়ি না। শেষ রাত। লোকমান তাহাজ্জুদ নামাজের কথা বলায় ইতি টানলাম। আজকেও দৃশ্যপটে লোকমান। তবে কাউকে কিছু বলতে হয়নি। ভিডিওতে আমার ক্লান্তি দেখে মালিক ভাই বললেন, মাহবুব সাহেবের শরীরটা ভালো দেখাচ্ছে না। আজ থাক এ পর্যন্তই।
সমাপ্তি টানার আগে তবারক ভাই ও আমার সম্পর্ক বিষয়ে কিছু বলা দরকার। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম, এখনো আছি। দু’জন ছিলাম ঢাকার দু’টি দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার, বেতনভুক্ত সাংবাদিক। এক সাথে খবর সংগ্রহ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, লেখালেখিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। তাঁর ধারণা হতে পারে, সম্পাদক হওয়ার জন্য আমি নতুন কমিটি গঠনে উদ্যোগী ছিলাম। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে এটা ছিল, ক্লাব সদস্যদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খার বিপরীতে অবস্থানের পরিণতি। (প্রসঙ্গ নির্বাচন)। প্রেসক্লাবের জমি লাভের পিছনে তাঁর অবদান ক্লাব অবশ্যই স্মরণ করবে। আমার মনে পড়ে, সম্ভবত আব্দুল ওয়াহেদ খানের কাছে শুনেছিলাম, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বলেছিলেন, কি ব্যাপার, প্রেসক্লাবের জমি বরাদ্দের পত্র তবারক হোসেইনকে আজ দিলাম, এখন শুনি আপনারা তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন।
এটা ছোট্ট এক ট্র্যাজেডী। আগেই বলেছি, একদিন আগে এ চিঠি এলে গল্পটিকে অন্যভাবে সাজাতে হতো।
প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লেখার জন্য মাঝেমধ্যে অনুরোধ আসে। লেখা হয় না। আজো ইতিহাস লিখছি না। মালিক ভাইর সাথে আলাপে পুরনো দিনের খানিকটা স্মৃতিচারণ করেছি। আমার সহকর্মী গিয়াস উদ্দিন আউয়াল ইতিহাস লিখেছেন। আজকের তথ্যগুলো তাঁর কাজে লাগবে কিনা জানি না।
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।
সংবাদটি ভালো লাগলে স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন